জেন্ডার বায়াসড সেক্স সিলেকশন (জিবিএসএস) নারী ও মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত – যার চর্চা নারী ও কন্যাশিশুসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি পক্ষপাতমূলক ধারা, যার মূলে রয়েছে জেন্ডার অসমতা।
কন্যাশিশু হত্যা, কন্যাশিশু জন্মের কারণে মায়েদের প্রতি অবহেলা এবং নানাবিধ বৈষম্য বুঝিয়ে দেয়, বিশ্বের বেশিরভাগ সমাজে এখনও নারী এবং মেয়েদের কতটা মূল্যহীন করে দেখা হয়। কিন্তু যুগে যুগে এই বৈষম্যমূলক পরিবেশের মধ্য দিয়েই আমাদের কন্যাসন্তানরা বড় হচ্ছে। এই বৈষম্য খাবার বন্টন থেকে শুরু করে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসহ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়।


এখন খুব সহজেই জানা যায়, গর্ভের সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে। ১৯৮০’র দশকে ডায়াগনস্টিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে চীন, ভারত, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ভিয়েতনাম, নেপালসহ অন্যান্য দেশে এই সম্পর্কিত কিছু উদ্বেজনক ঘটনার আবির্ভাব ঘটে। যেমন, গর্ভের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে—এর ওপর নির্ভর করে গর্ভাবস্থায় ভ্রুণ নষ্ট করার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে কী আচরণ করা হবে। আর জন্মের পরে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য তো আছেই – সেটা কন্যাশিশু হত্যা থেকে শুরু করে খাবারদাবার ও টিকাদানের মত মৌলিক ব্যাপারে অবহেলা-অযত্নেও প্রকাশ পেতে থাকে, যে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমীক্ষায় অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের কন্যাশিশু মৃত্যুর হার বেশি পরিলক্ষিত হয়।


২০১৯ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশে মেয়ে ও ছেলেশিশুর জন্মের অনুপাত হলো ১:০৬, যার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশে প্রত্যেক ১০৬ ছেলে শিশুর বিপরীতে ১০০ মেয়ে শিশুর জন্ম হচ্ছে – অর্থাৎ বাংলাদেশ জিবিএসএসের ঝুঁকি আছে। এছাড়া দেশের কিছু বিভাগে এই জন্মের অনুপাত ১১০ বা তারও বেশি। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, এই অনুপাত ৭৭.৫ শতকরা হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার ফলে ২০২১–২১০০ সালের মধ্যে দেশে ‘নিখোঁজ নারীর’ সংখ্যা ১২ লাখ ৫১ হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে। তাই, এটা প্রতিরোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।


যেকোন সমাজে জিবিএসএসের আবির্ভাবের জন্য যে তিনটি উপাদান থাকতে হয় তা হল, পুত্রসন্তানের অগ্রাধিকার, সন্তান জন্মদানে ফার্টিলিটি বা উর্বরতা হ্রাস এবং যৌন-শনাক্তকরণ প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও ব্যবহার – বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই তিনটি উপাদানই উপস্থিত।। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বা ‘ইউএনএফপিএ’র মতে, পুত্রসন্তানের অগ্রাধিকারের মত পক্ষপাতমূলক সামাজিক রীতিকে নির্মূলের মাধ্যমেই কেবল জিবিএসএসের উত্থান রোধ করা সম্ভব, যা একই সাথে বাল্যবিবাহ, নারীদের প্রতি সহিংসতা, “সম্মান রক্ষার্থে” নারী হত্যা, যৌতুকের বলি হওয়ার মতো সমস্যাগুলোকে প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখবে।

দেশের বিভিন্ন সামাজিক স্তরে পুত্রসন্তানের জন্য পরিবারের আকাঙ্ক্ষা বেশি, যার পিছনে রয়েছে পক্ষপাতমূলক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণ। ২০১৯ সালে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ২৮ শতাংশ নারী এবং ২৪ শতাংশ পুরুষ তাঁদের প্রথম সন্তান ছেলে চান। এটি বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০১৪-এর সমীক্ষার বিশ্লেষণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে ‘পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা’-এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।


জাতীয়ভাবে নারীদের ওপর করা সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণায় যদিও দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী মা-দের মধ্যে ছেলেসন্তান এবং মেয়েসন্তানের প্রতি আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি ভারসাম্য এসেছে, যার মূলে রয়েছে নারীশিক্ষার প্রসার এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কিন্তু এখনও পরিবার পরিকল্পনার সাথে যুক্ত সীদ্ধান্তগুলো প্রভাবিত হচ্ছে পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষার মত ক্ষতিকর সামাজিক রীতি দ্বারা।
উত্তরাধিকার নির্ধারণ এবং সম্পত্তির অধিকারের মত ব্যাপারে ছেলেসন্তানের অগ্রাধিকারের কারণে এখনও অনেক মা-বাবাই ছেলেসন্তান আশা করেন। ২০১৯ সালের ইউএনএফপিএ-এর সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, পুত্রসন্তান না হলে নানা রকম অবহেলা, অপমান, চাপ এবং এমনকি শারীরিক সহিংসতাসহ বৈষম্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হতে হয় মা-দের।

২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউএনএফপিএ – জাতিসংঘের জনসংখ্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাপী এই ধারার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, এই অন্যায় ও বৈষম্য প্রতিরোধ করার আহ্বান করছে। বাংলাদেশসহ বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পুত্রসন্তানের অগ্রাধিকার এবং কন্যা বিমুখিতার মূল কারণ হিসেবে জেন্ডার অসমতাকে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘের এই সংস্থা – এই অসমতা বিলোপে কাজও করতে হবে গোড়া থেকেই। তাই পরিবার, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ইউএনএফপিএ কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।



এবার ‘কথা হোক’

এই প্রেক্ষাপটে, ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ ২০২২ সালে ‘সেলিব্রিটিং ডটার্স’ শিরোনামে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করে। এতে নেতৃত্ব দেয় দেশের তরুণ সমাজ। এই প্রচারাভিযানের মাধ্যমে নারী ও কন্যাশিশুদের মূল্যায়নের বিষয়ে সচেতন করা হয়। তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে, কন্যা বিমুখিতার মত রীতিনীতি ও বৈষম্যমূলক আচরণ যে সমাজের জন্য অভিশাপ —তা তুলে ধরা হয়।

সেই ধারাবাহিকতায় এবার শুরু হয়েছে ‘কথা হোক’ শিরোনামে বিশেষ প্রচারাভিযানের। যার মূল উদ্দেশ্য হলো ইতিবাচক পুরুষত্বের প্রচারণা; আর চাওয়া হলো, নারী-পুরুষে বৈষম্য নয়, সমধিকারে সবাই এগিয়ে যাবে, এবং পুত্রসন্তানের অগ্রাধিকার ও এবং কন্যা বিমুখিতার মত ক্ষতিকর সামাজিক রীতিনীতি নির্মূল হবে। এবং এই লক্ষ্যে, এবারের প্রচারাভিযানেরর কেন্দ্রে রয়েছেন বাবারা।

দীর্ঘদিন ধরে সমাজে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে বাবা শুধু পরিবারের জন্য, সন্তানদের জন্য উপার্জন করবেন। সন্তানদের দেখাশোনায় তার কোনো ভূমিকা নেই, আর কন্যাসন্তান পালনে বাবার ভূমিকা একবারে নগণ্য। আশার বিষয় হল, কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে বাবারাও এখন নিয়মিতভাবে কন্যাসন্তানের পরিচর্যা ও লালন-পালনে যুক্ত হচ্ছেন। ‘উপার্জনকারী’, ‘পারিবারিক কর্তা’, ‘সন্তানের শাসক’-এর বাইরেও যেন বাবারা তাঁদের পারিবারিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করছেন। তাঁরা সহানুভূতি, আবেগ এবং ভালোবাসার আদর্শের প্রতীক হচ্ছেন।


দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কন্যার জন্য, পরিবারের মধ্যে অযত্ন এবং অবহেলার বেদনাদায়ক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়ে যত্ন, ভালোবাসা, এবং অবলম্বনের বাবাকে পাওয়া— এই লক্ষ্য নিয়েই এই প্রচারাভিযান কাজ করবে।

২০২১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশী পুরুষরা ০.৮ ঘণ্টা ঘরের কাজ এবং সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের যত্নের কাজে ব্যয় করেন, যেখানে নারীরা দৈনিক ব্যয় করেন ৫.৯ ঘণ্টা। এই সমীক্ষা থেকেই দেখা যায়, পুরুষরা যত্নের কাজে নারীদের তুলনায় ৭.৫ গুণ কম কাজ করেন। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা একাই পরিবারে ৮৮ শতাংশ পরিচর্যার কাজ করে থাকেন। যা শুধু শ্রমের জেন্ডার-ভিত্তিক বিভাজনই নয়, পিতৃত্বের প্রচলিত মডেলকেও তুলে ধরে, যেখানে বাবারা যেন পরিবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। অথচ শুধু মা-রাই নয়, বাবাদেরও তো দায়িত্ব সন্তান লালন-পালন, ঘরের কাজ ও সর্বোপরি সন্তানের জীবনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। পরিবারে এই রূপান্তর আনার লক্ষ্যেই ইউএনএফপিএ তাদের কাজ করছে, আর সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো ডটকম - কেননা নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার কাজটি পরিবার থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে।

গবেষণায় দেখা যায়, কোনো পরিবারে বাবা যদি ঘরোয়া কাজে নিয়োজিত থাকেন, সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেন এবং পরিবারের সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখেন তাহলে সেই পরিবারের সন্তানদের ভবিষ্যতের গড়ন সুন্দর হয়। বাবার নিবিড় পরিচর্যা কন্যাসন্তানের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই আচরণ কন্যাদের উচ্চাভিলাষী কর্মজীবন পরিকল্পনায় ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সেইসঙ্গে শিক্ষাগত অর্জন, উন্নত মানসিকতা গঠন, আপনজনদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি, সেইসাথে সমাজে নারী-পুরুষ সমতা বিকাশে সাহায্য করে।

পুরুষ মানেই বাইরের কাজে ব্যস্ততা, ঘরের কাজে উদাসীনতা, সবার উপর কর্তৃত্ব দেখিয়ে বেড়ানো—এই চিরন্তন ধারা থেকে বের হয়ে পুরুষরাও হতে পারেন ঘরের কাজের সাহায্যকারী, সন্তানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং সমাজে অহিংসতার প্রতীক। স্ত্রীর সঙ্গে থাকবে প্রেমময় সম্পর্ক, সন্তানদের প্রতি হবেন দায়িত্বশীল-প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আর কন্যাসন্তানের জন্য হবেন যত্নের বিমূর্ত প্রতীক—বাবাও যে এমন আদর্শ মডেল হতে পারেন, সেজন্য এই ‘কথা হোক’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইউএনএফপিএ এবং প্রথম আলো ডটকম। এ আয়োজনে বাবা ও কন্যাদের চিঠিগুলো একটি সুন্দর ও সাহসী ভবিষ্যতের বার্তা দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যেখানে পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের মধ্যে পারিবারিক-সামাজিক বৈষম্য শুধু অতীত পৃথিবীর কথাই বলবে।